ক্লাস বন্ধের এই সময়ে আমাদের বিশেষ শিশুগুলোর পূর্ণ সময় বাসায় অবস্থান হওয়ার ফলে তাদের অতিচঞ্চল হবার সম্ভাবনা বেশি । তাদের প্রতিদিনের রুটিনটা যেহেতু অন্য রকম হবে, এ সময় ওদের যত্নটাও একটু বেশি দরকার ।
অভিভাবকদের কাছে অনুরোধ থাকবে, বাচ্চাগুলোর স্কুল থেকে যে আই. ই. পি ( প্রতিটা বাচ্চার এডুকেশন এর জন্য যে আলাদা প্ল্যান করা হয় ) করা হয়েছে সেটার শর্ট টার্ম গোল এর কপি সংগ্রহ করে, সেভাবে বাসায় হোম টিচিং দিন। বাবা-মা এর থেকে বড় কোনো শিক্ষক নাই।
স্পেশাল স্কুলগুলোর উচিত, ক্লাসের শিক্ষকদের তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা শিশুগুলোর অভিভাবকদের ছোট ছোট (সম্ভব হলে ওয়ান টু ওয়ান গ্রুপ) তৈরী করে দেয়া । শিক্ষকদেরও উচিত হবে, সেই অভিভাবকদের সাথে আগামী ২-৩ মাস নিয়মিতভাবে অনলাইনে (ইমেইল) হোম টাস্ক দেয়া এবং ফোন এ কাজগুলো বুঝায়ে দেয়া । আই. ই. পি ধরে ধরে প্রত্যেকটা ডোমেইনের যে কাজ গুলো বাসায় করানো সম্ভব, বাবা-মা কে ডেমো দিলে উনারা অবশ্যই পারবেন ।
টেকনোলজি এর যুগে সপ্তাহে ১ দিন, শিক্ষকের পক্ষে হোয়াট–এপ্স অথবা ভাইবার এ ১০ মিনিটের জন্য শিশুটির সাথে ভিডিও তে খোঁজখবর নেয়া খুবই সম্ভব। স্পেশাল শিশুদের জগৎটা খুবই ছোট, সেই জগতে তার প্রতিদিনের শিক্ষক অনেকটুকু জুড়ে থাকে। অনেক সময় সেই স্পেশাল শিক্ষককে দেখা মাত্র, শিশুটি শান্ত হয়ে যায়। এই সামান্য ফোন করতে কোনো শিক্ষকই অরাজী হবেন না, বরং খুশিমনেই করবেন – শুধু স্কুলগুলোকে পথটা দেখায়ে দিতে হবে। একটি বিশেষশিশুর যে কোনো সাফল্যে শিশুটির শিক্ষকের মনে যে কি পরিমান গর্ব হয় – শিক্ষক না হলে সেটা বুঝানো যাবেনা।
কোরোনা ভাইরাস এর মহামারীর সময় কোনো অবস্থাতেই শিশুকে বাসার বাইরে নিয়ে ( অথবা থেরাপিস্টকে বাসায় এনে ) থেরাপি দেয়া সমুচিত হবে না। বাচ্চার উন্নতি থমকে যাবে হয়ত, সামান্য অবনতিও হতে পারে – কিন্তু মনে রাখবেন বাচ্চার স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা সবার আগে। এই বিশেষশিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কম থাকে, এদের হাইজিন বুঝার ক্ষমতা হয় নাই এখনো।
এই সময়টা কাজে লাগান। নিজের বাচ্চার কোন কোন ডোমেইন এ ( একাডেমিক, মোটর স্কিল, সেন্সরি ইত্যাদি) কি কি সমস্যা আছে – নিজে আরো ভালো করে আবিষ্কার করুন, লিস্ট করুন, শিক্ষককে জানান । নিজে নিজে কিছু এক্সপেরিমেন্ট করুন। শিশুটির সামনে দিয়ে দেখুন, কোনো আগ্রহ জন্মায় কিনা – এভাবে আপনি নিজেই আপনার শিশুর বিশেষ কোনো জন্মগত দক্ষতা থাকলে সেটা বের করে ফেলতে পারবেন। যেহেতু বিশেষ শিশুদের ব্রেইনের কিছু অংশ কম কাজ করে, প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে অন্য কোনো অংশ বেশি কাজ করার কথা- সেটি খুঁজে বের করুন। যেমন অনেক বিশেষ শিশু ছবি আঁকা, অংক, কম্পিউটার গেমস, মেমোরাইজাসন ( শব্দ মনে রাখা ), সুর তোলা – এগুলোতে জন্মগতভাবে পারদর্শী হয়।
এবার অভিভাবকদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কথা বলতে চাই। আমাদের দেশে গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোয়ালিটি স্পেশাল এডুকেশন প্রদান করা হয় না। প্রয়োজনের তুলনায় এই স্পেশাল এডুকেশন স্কুলগুলোর সংখ্যা নগন্য। বেশিরভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং হয়তো বড় মাপের কয়েকটি স্কুল ছাড়া বাকিরা সরকারি / এন-জি-ও এর সাহায্য পায় না। এই স্কুলগুলোর টিকে থাকা, শিক্ষকদের বেতন দেয়া এবং কোয়ালিটি বজায় রাখা -এই সব কিছুই অভিভাবকদের দেয়া টিউশন ফী এর উপর নির্ভর করে। এই মহামারীর সময় অনেক অভিভাবকের আয় কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।এর মধ্যে বাচ্চা যেহেতু স্কুলে যাচ্ছেনা, থেরাপি নিচ্ছে না – অনেক অভিভাবকই হয়তো তাদের বেতন পরিশোধ করতে চাইবেন না। এতে যেটা হবে, অনেক উঠতি ভালো স্কুলকে অফিস এবং বাসা ভাড়া না দিতে পারায় প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হবে, কোয়ালিফায়েড শিক্ষকদের বেতন দিতে না পারলে উনাদেরকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হবে। মনে রাখবেন, স্কুলগুলোকে টিকিয়ে রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব । এই স্কুলগুলো টিকলে, সামনে আরো এই ধরণের স্কুল প্রতিষ্ঠা হবে , প্রতিযোগিতামূলক সার্ভিস এবং কোয়ালিটি বাড়বে, একচেটিয়া ব্যবসা বন্ধ হবে, সামগ্রিক খরচ ও কমে আসবে।
প্রত্যেক অভিভাবক এবং স্কুলগুলোর আলাদা আলাদা স্ট্রাটেজি থাকতে পারে – সেগুলোর প্রতি সন্মান জানিয়েই আমাদের স্ট্রাটেজি শেয়ার করা হলো যেন অভিভাবক এবং স্কুলগুলোর সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হয়। আল্লাহ আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের সুস্হ রাখুক । ভাইরাস এর দুর্যোগ কেটে যাক । এই বিশেষ শিশুদের কলতানে স্পেশাল স্কুলগুলো আবার ভরে উঠুক।
-ডাঃ রাহাত চৌধুরী
চেয়ারম্যান,
কিডি রকস , ধানমন্ডি, ঢাকা।